লেবাননঃ দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দেয়া বৈরুত বিস্ফোরণ

আজ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বৈরুত এলাকার জনগণের ঘুম ভাঙবে গতকাল লেবাননের কেন্দ্রীয় রাজধানীতে ঘটে যাওয়া এক ধ্বংসাত্মক নির্মম বিস্ফোরণের ধ্বংসস্তূপে, দালানকোঠার ধ্বংসাবশেষ, উল্টে পড়া গাড়ি ও যানবাহন এবং বিস্তর এলাকাজুড়ে ভেঙে যাওয়া জানালার কাঁচের টুকরোর স্তূপের মধ্যে। 

অনেক বছর ধরেই বৈরুত অনেক ভয়ংকর সর্বনাশের মুখোমুখি হয়েছে কিন্তু এই বিস্ফোরণই হয়ত উক্ত শহরের উপর আঘাত হানা সবথেকে নির্মম বেদনাদায়ক ঘটনা।

জনগণের মোবাইলে ধারনকৃতি ভিডিওচিত্র থেকে দেখা যায় প্রথমে ঘন ধোয়ার মেঘ এবং পরবর্তী মুহূর্তেই একটি বিরাট বিস্ফোরণ যা বহু কিলোমিটার দূর পর্যন্ত শকওয়েভের তৈরী করেছিল। প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটার খানিকক্ষন পরেই দ্বিতীয় বড় বিস্ফোরণটি ঘটে, যে বিস্ফোরণের শব্দ সুদূর সাইপ্রাসেও শোনা গিয়েছিল।

বিস্ফোরণ থেকে উৎসারিত বিশাল মাশরুম ক্লাউড যা মূলত বিধ্বংসী নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণের অনুরূপ, ফলাফলও সেরকমই দেখতে পাই আমরা, পুরো শহরটিই একেবারেই উল্টেপাল্টে যায় বিস্ফোরণের কারনে। সে এক নারকীয় দৃশ্য, দালানকোঠা ভেঙে ছাতু হয়ে যাওয়া এবং টনকে টন কাঁচ পুরো শহরের আতঙ্কিত জনগণের উপর স্পিন্টারের মত পতিত হওয়া।

ঝলসে যাওয়া এবং রক্তমাখা দেহ নিয়ে শতশত মানুষ ছোটাছুটি করছিল রাজপথে একটু সাহায্যের জন্য। কিন্তু বৈরুতের হসপিটালগুলো ইতোমধ্যেও করোনা রোগীদের ভীরে গমগম করছিলো, যা সামাল দেয়ার থেকেও অতিরিক্ত। এবং নিশ্চই এখনও অনেক মানুষই হয়তো চাপা পড়ে রয়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচে, লেবাননের এই গর্বিত শহর পুরোটাই এখন মূলত ধ্বংসস্তূপ, মৃত্যুপুরী।

কত মানুষ নিহত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যাটি এখনও জানা যায়নি, তবে অবশ্যই তা প্রাথমিকভাবে আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট যেখানে বলা হয় “ডজনখানেক” নিহত হয়েছে, তার থেকে ঢের বেশি হবে সংখ্যায়। বিস্ফোরণটি ঘটেছিল দিনের এমন একটি সময়ে যখন প্রায় সব মানুষই রাস্তাঘাটে ঘোরাফেরা করে তাপদাহে কাটানো ক্লান্ত দিনের শেষে। এছাড়াও এটি ছিল বন্দরঘেষা এলাকা, এই এলাকায় রয়েছে অসংখ্য বার এবং রেস্টুরেন্ট।

লেবানিজ রেড ক্রসের প্রধান এক বিবৃতিতে জানায় প্রায় চার হাজারেরও বেশি সংখ্যক মানুষ আহত হয়েছে এবং নিহতের সংখ্যা সম্ভবত ১০০ ছুঁয়ে যাবে। যে পরিমাণে বিস্ফোরণ আমরা দেখতে পেয়েছি, সেটিকে আমলে নিলে এই সংখ্যাটিও নেহাত তুচ্ছ।

অনেক মানুষই এখনও নিখোঁজ। কিছু ভুক্তভোগী এখনও দালানকোঠার ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে, কারন উদ্ধারকর্মীরা এখনও তাদের নিজের জীবন বাজি রেখেও তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে উক্ত বন্দর এলাকার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, কারন উদ্ধারকাজ করতে গিয়েও অনেক উদ্ধারকর্মী ঠুনকো দালানকোঠা ফের ভেঙে পড়ে চাপা পড়তে পারে।

বিস্ফোরণের ফলে অতীব গুরুত্বপূর্ণ শস্য গুদামগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে। লেবানন দেশটির মূলত ৮০ভাগ গমের সাপ্লাই আসে আমদানির মাধ্যমে। কিন্তু এখন এটা নিশ্চিতভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে উক্ত বিস্ফোরণের ফলে বৈরুতের এই বন্দরটির সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে এবং আমদানি কাজও ব্যহত হবে।

এটি একেবারেই গজবের শামিল একটি মানব ট্রাজেডি। এবং এর ফলে লেবাননকে চড়া মূল্যও পরিশোধ করতে হবে ভবিষ্যতে।

লেবাননের সংকট

এই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণটি লেবানন সমাজের একেবারে মূলে আঘাত করেছে। এটি এমন এক সময়ে আঘাত হেনেছে যখন কিনা উক্ত দেশটি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সবদিক থেকেই সংকটের মুখে এবং বিদীর্ণ অবস্থার মধ্যে।

অর্থনৈতিক সংকটের ফলে বিশাল সংখ্যক জনগণ আজ দারিদ্র্যের কবলে। লেবানিজ শ্রমিকেরা একইসাথে বিপদজনক কর্ম পরিবেশ, মুদ্রার নিম্নগামী মান, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এবং উঠতি বেকারত্বের মুখোমুখি বর্তমান সময়ে। না খেয়ে দিনযাপন করা শ্রমিকের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে উক্ত এলাকায়।

বিক্ষুব্ধ জনগণের সামনে উক্ত এলাকার আতঙ্কিত রাজনীতিবিদেরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছে যেভাবে পারা যায় কিছুটা হলেও নিজেদের গদি সামাল দিতে, যদিও তাদের গদি ইতোমধ্যেই নড়বড়ে হয়ে ছিলো বর্তমানের এই ধ্বংসাত্মক ট্রাজেডি ঘটার আগে থেকেই।

এখন হঠাৎ করেই তারা জনগণের দাবী রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়া শুরু করেছেঃ দোষীদের আইনি আওতায় শাস্তি দেয়া হবে; ঘরবাড়ি পুনরায় নির্মাণ করে দেয়া হবে, বিস্ফোরণে ভেঙে যাওয়া লাখ লাখ জানালাও মেরামত করে দেয়া হবে- এবং এ সবই করে দেয়া হবে সরকারী অর্থায়নে।

লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব অঙ্গীকার দিয়েছেন যে, যারাই এই বৈরুতের বিস্ফোরণের জন্য দায়ী তারা অবশ্যই “কড়া মূল্য পরিশোধ” করবে এর জন্য। তিনি এই বিস্ফোরণের কারন হিসেবে বলেছেন ২৭০০ টন এমোনিয়াম নাইট্রেট, যা সার ও বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরীতে ব্যবহার করা যেত।

অঙ্গীকারবদ্ধ এসব চমৎকার কাজগুলো সম্পাদন করা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীদের ধ্বসে পড়া ভাবমূর্তি মেরামতের তুলনায় বেশ সহজই হবে। উক্ত সরকারকে আর কেউই বিশ্বাস করেনা। তাদের অঙ্গীকারেও আর কারও বিশ্বাস নেই। এখন জনগণ এই আঘাত হানা বিস্ফোরণের পিছনে কারন ও ব্যাখ্যা দাবী করছে। 

দায় কার?

একেবারে প্রথম যে আশংকাটি সবার মাথায় এসেছিলো তা হচ্ছে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলার কথা। উক্ত অঞ্চলে চলমান অস্থিতিশীল পরিবেশ এমনটিই ইঙ্গিত করে, এবং বিশেষ করে লেবাননের যে অসুরক্ষিত ব্যবস্থা, তাতে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছিলো না। কিন্তু এখন ঘটনাটি সেরকম হবার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা, সেদিক থেকে ব্যাখ্যাও করা যাচ্ছেনা।

আরেকটি আশংকার সম্ভাবনা ছিলো কোনও বহিঃশক্তির আক্রমণ। লেবানন অনেক বছর ধরেই বহিঃশক্তির আক্রমণের জন্য একটু উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে রয়েছে, সুতরাং এটাও হয়তো একটি যৌক্তিক অনুমান হিসেবে ছিল। ওয়াশিংটনের দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে দায় করা যেত যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকদিন ধরেই ইরানের প্রতি রুষ্টভাব নিয়ে বসে আছে, তার জন্যও লেবানন একটি আক্রমণের টার্গেট হতে পারে।

কিন্তু পৃথিবীর এই বিস্ফোরকপূর্ণ এলাকায় কামড় বসানোর তিক্ত স্বাদ আমেরিকানরা পূর্বেও বহুবার পেয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে খুব বেশি পায়তারা করার ফল তাদের জন্য ভাল হয়না তাও তারা বুঝেছে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। যদি এই অঞ্চলে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলা করাতেই হতো, তাহলে আমেরিকা তার চিরবন্ধু ইসরায়েলের সাহায্য নিতো।

লেবানন এবং ইসরায়েলের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি তিক্ত হয়ে উঠেছে, দুইদেশের সীমান্ত অঞ্চলের অস্থিরতা জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার কাজটি করেছে একেবারে নিঁখুতভাবে। ইসরায়েলের আক্রমণে সিরিয়াতে লেবানিজ হেজবোল্লাহর একজন সৈন্য নিহত হয়েছিল যা বেশ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, এটিও বেশিদিন আগের কথা নয়। তাহলে কি ইসরায়েল দায়ী?

ইসরায়েলিরা খুব দ্রুতই বৈরুতের এই বিস্ফোরণের পিছনে তাদের কোনও দায় নেই বলে বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন। এরকম আনুষ্ঠানিক বিবৃতিগুলোকে অবশ্যই প্রচন্ড সন্দেহজনক চোখেই দেখা উচিত। কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রে তাদের এই বক্তব্য সত্যও হতে পারে।

অন্যসব কিছু বাদ দিয়ে হিসাব করলেও, এই ধরনের স্পষ্ট দায় অস্বীকারের বিবৃতি ইসরায়েলের গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ দায় স্বীকার বা অস্বীকার কোনওটাই না করা, তার সাথে সাংঘর্ষিক। এই গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে সরে আসাটা তাদের জন্য অস্বাভাবিক ব্যাপার, যার ফলে অন্তত এই ঘটনার ক্ষেত্রে তাদেরকে কিছুটা হলেও বিশ্বাস করা চলে সম্ভবত।

তবে এর থেকেও বেশি কৌতুহল উদ্দীপনাকারী প্রতিক্রিয়া ছিল লেবানন সরকারের। উক্ত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা প্রধান বলেন, উক্ত বিস্ফোরণটি এমন একটি এলাকায় ঘটেছে যেখানে উচ্চ বিস্ফোরক দ্রব্যাদি গুদামজাত অবস্থায় ছিল। হ্যা সেটা হতে পারে। কিন্তু এমন বিবৃতি কোনওকিছু ব্যাখ্যা করেনা আসলে।

যদিও উক্ত বিস্ফোরণের যথাযথ কারন এখনও উদ্ঘাটিত হয়নি, তবে এটি অনেকটাই পরিষ্কার যে ওমন রাক্ষুসে কর্মকান্ড তখনই সম্ভবপর হয় যখন এর পিছনে বছরে পর বছর চলতে থাকা লেবাননের নিজস্ব দুর্নীতিবাজ সরকার পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠী এলিটদের লুঠতরাজ এবং শোষণের মাৎস্যন্যায় বিরাজমান থাকে।

গত ছয় বছর ধরে এমন মানব কোলাহলপূর্ণ বন্দর এলাকায় ২৭৫০টন মরণঘাতী এমোনিয়াম নাইট্রেট গুদামজাত করে রাখা হয়েছিল, তা কেবলমাত্র এখন জানতে পারছে লেবাননের সাধারণ জনগণ, তাও এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাটি ঘটার পর। 

কিন্তু পাবলিক রেকর্ড এবং ডকুমেন্টস অনলাইনে প্রকাশিত হবার পর দেখা যাচ্ছে, লেবাননের সরকারী কর্মকর্তারা এটি আগে থেকেই জানতো যে এই মরণঘাতী এমোনিয়াম নাইট্রেট বৈরুতের ১২নম্বর বন্দর ডকে গুদামজাত করে রাখা হয়েছিল। তারা এর বিপদ সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল ছিলেন।

অপেক্ষারত দুর্যোগ

এই মরণঘাতী কার্গোগুলো কীভাবে এখানে এসে পৌঁছেছিল তা সম্পর্কে আল জাজিরা  কিছু আলোকপাত করেছেঃ

“এমোনিয়াম নাইট্রেটের কার্গো লেবাননে এসে পৌঁছেছিল ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে, কার্গোটি রাশিয়ার মালিকানাধীন মল্ডোভান পতাকাবাহী একটি জাহাজে করে এসেছিল। জাহাজ-ট্রাকিং সাইট ফ্লিটমনের তথ্যানুযায়ী এমভি রোসাস জাহাজটি জর্জিয়া থেকে মোজাম্বিকের দিকে যাচ্ছিল।”

“সমুদ্রে যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হবার কারনে এটি বৈরুত বন্দরে থামতে বাধ্য হয়েছিল জাহাজের নাবিকদলের সমর্থনে এমনটিই দাবী করেছিল আইনজীবীরা(বিস্তারিত পিডিএফ)। কিন্তু লেবানন উক্ত জাহাজটিকে বন্দরে নোঙর করার অনুমতি দেয়নি যার ফলে জাহাজটি ওভাবেই রেখে দিয়ে জাহাজের মালিক এবং নাবিকদলদের চলে যেতে হয়- এমনটি সুনিশ্চিত হওয়া যায় ফ্লিটমনের রিপোর্ট অনুযায়ী”

“পরবর্তীতে জাহাজের এই বিপদজনক কার্গোগুলোকে বৈরুতের ১২নাম্বার ডকে খালাস করা হয়, এটি উক্ত শহরে উত্তর-দক্ষিনে অবস্থি সড়কপথের পাশে অবস্থিত যেটি মূলত শহরের প্রবেশমুখে অবস্থিত” 

“এর কয়েকমাস পর ২০১৪ সালের ২৭শে জুন লেবানিজ কাস্টমস অফিসের পরিচালক শফিক মের্হি একটি বেনামি চিঠি পাঠায় “Urgent Matters judge” শিরোনামে এবং অনলাইনে শেয়ারকৃত তথ্যাবলীর ভিত্তিতে উক্ত সমস্যার সমাধান দাবী করে”

“পরবর্তী তিনবছর সময়কালে কাস্টম অফিস থেকে কম করে হলেও পাঁচটি চিঠি পাঠানো হয় সমাধান দাবী করে, চিঠিগুলো পাঠানোর তারিখ যথাক্রমেঃ ৫ই ডিসেম্বর ২০১৪, ৬ই মে ২০১৬, ২০শে মে ২০১৬, ১৩ই অক্টোবর ২০১৬, এবং ২৭শে অক্টোবর ২০১৭। তারা তিনটি অপশন প্রস্তাব করেছিল সমাধানেরঃ এমোনিয়াম নাইট্রেট রপ্তানি করে দেয়া, লেবানন আর্মির হাতে তুলে দেয়া অথবা এটিকে বেসরকারি লেবানিজ বিস্ফোরক দ্রব্য কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে দেয়া।”

“২০১৬ সালে পুনরায় চিঠি পাঠানো হয় এবং বলা হয় যে উর্ধ্বতন বিচারকদের কাছ থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা, দ্রুতই যেন সাড়া দেয়া হয়। 

“উক্ত চিঠিতে আর্জি জানানো হয়ঃ

“এই ধরনের দ্রব্যসামগ্রী ডকে রাখার জন্য উপযুক্ত নয় এবং পরিবেশগত কারনে এটি খুবই বিপদজক, যে কারনে পুনরায় অনুরোধ করা হচ্ছে যাতে করে মেরিন এজেন্সির উদ্যোগে এগুলোকে পুনরায় রপ্তানি করা হয় যত দ্রুত সম্ভব বন্দরের সুরক্ষার স্বার্থে এবং বন্দরের কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য, অথবা এসব দ্রব্যগুলোকে যাতে লেবানিজ বিস্ফোরক দ্রব্য কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে দেয়ার একটা ব্যবস্থা বন্দোবস্ত করা হয়”

“আবারও, কোনও জবাব আসেনি।”

একবছর পর, লেবাননের নতুন কাস্টম প্রশাসক বাদরি দাহের আবারও একজন বিচারকের কাছে চিঠি লিখেন।

“২৩শে অক্টোবর ২০১৭ সালে দাহের একজন বিচারককে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানান, তিনি চিঠিতে লিখেন এসব দ্রব্যাদি খুবই বিপদজনক উক্ত স্থানের জন্য এবং উক্ত স্থানে যারা কর্মরত তাদের জন্য।”

“প্রায় তিনবছর পরে, এমোনিয়াম নাইট্রেট এখনও সেখানেই ছিল।”

একটি দুর্নীতিগ্রস্ত পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা

বৈদেশিক সাংবাদিক এবং পর্যবেক্ষক যারা অতিসরল এবং চরম গর্দভ স্বভাবের দোষে দুষ্ট তাদের মনে এসব দেখে প্রশ্ন জাগে যে কীভাবে এত পরিমাণে উচ্চ বিস্ফোরক দ্রব্য এতবছর ধরে(২০১৪ থেকে) এরকম একটি জনবহুল এলাকা এবং একটি দেশের কেন্দ্রীয় রাজধানী শহরের নিচে গুদামজাত অবস্থায় থাকে?

তাদের কাছে এই ব্যাপারটি বিস্মকয় বলে মনে হতে পারে। এবং তারা আরও বিস্মিত হতে পারে এটা জেনে যে কেউই রাষ্ট্রীয় এসব বিতর্কিত কর্মকান্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি। এসবের বিরুদ্ধে কোনও তদন্তও হয়নি। অথবা যদিওবা তদন্ত হতো, তার কোনও রিপোর্ট প্রকাশিত হতোনা, কাউকে দোষী সাভ্যস্ত করে গ্রেফতারও করা হতোনা, এমনটা বললে অতিশয়োক্তি হবেনা যে, এই বিশাল পরিমাণে বিস্ফোরক দ্রব্য বৈরুতে পুতে রাখা হয়েছিল বিস্ফোরিত হবার জন্যেই।

তবে লেবাননে কেউই এসব বিষয়ে সরকারকে প্রশ্ন করার কথা স্বপ্নেও ভাবেনা, কারন এসব প্রশ্নের উত্তর তাদের ভালোভাবেই জানা রয়েছে। জনগণের সাথে এরকম আচরণই করা হয়ে থাকে লেবাননে। এভাবেই চলে আসছে, এভাবেই চলবে যতক্ষন পর্যন্ত এই নষ্ট ব্যবস্থাকে টিকে থাকতে দেয়া হবে।

বেশিরভাগ লেবানিজরা খুবই পরিষ্কার এই ধরনের ঘটনার পিছনে মূল কারনসমূহ কী হতে পারেঃ দুর্নিতীবাজ পুঁজিবাদী রাজনৈতিক শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত একটি অব্যবস্থাপনামূলক রাষ্ট্র। উক্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে বৈরুতের বন্দর “আলী বাবা এবং চল্লিশ চোরের গুহা” নামে পরিচিত। এটি এমন এক স্থান যেখানে বহুবিধ কুকর্ম সংগঠিত হয়ে রাষ্ট্রীয় মদদে, রাষ্ট্রীয় কর্মীদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকাপয়সা এবং অবৈধ সম্পদ কাস্টম কর ফাঁকি দিয়ে এখানেই মজুদ রাখা হয়।

দশকের পর দশক ধরে রাজনীতিবিদেরা এবং আমলারা এসব অপরাধ করে পার পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু সবকিছুইর সীমা থাকে। এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে লেবাননের জনগণের ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে গিয়েছে। গতকালের বিস্ফোরণ ছিলো ভারবাহী উটের পিঠে উঠিয়ে দেয়া শেষ খড়স্তূপ যা তার মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে।

আল জাজিরা  লেবাননের একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট রিমা মাজেদের বক্তব্য তুলে ধরেঃ

“বৈরুত এখন ধ্বংসের মুখে এবং গত দশকগুলোতে যারা এখানকার শাসকগোষ্ঠী তারা এই দায় এড়াতে পারেনা। এরা সবাইই সমান অপরাধী এবং বৈরুতের এই ঘটনা সম্ভবত এখন পর্যন্ত তাদের অন্যতম জঘন্য অপরাধ।”

অর্থনৈতিক পতন

যে ডাকাতদল লেবাননের শাসকগোষ্ঠী হিসেবে ভূমিকা করে আসছে তাদের তত্ত্ববধানেই এই নজিরবিহীন অর্থনৈতিক পতনের মুখোমুখি আজ লেবানন। এসব লোকেরা হাড়ে হাড়ে শয়তান এবং দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতি এদের মজ্জাগত। লেবানিজ পাউন্ডের অকল্পনীয় পতন ঘটেছে। বৈশ্বিকভাবে লিরা(লেবানিজ পাউন্ড) এর অধিকাংশ মূল্য হারিয়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লিরার মূল্য প্রতি ডলারে ১৫০০ হলেও কালোবাজারে প্রতি ডলারের বিনিময়ে ৪৫০০ লিরা পর্যন্ত পাওয়া যায়। তবে এতে ধনিক শ্রেণীর কিছু আসে যায়না কারন তারা দ্রুতই নিজেদের আখের গুছিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে এ ক্ষতি গুছিয়ে নিতে পারে। যেখানে অতিঃমূল্যস্ফীতির কারনে দিনকে দিনকে গরীবদের জীবনযাপনের মানের পতন ঘটছে এবং মধ্যবিত্তরাও নতুন নতুন গরীবে পরিণত হচ্ছে, সেখানে উক্ত ধনিক শ্রেনী আরও ধনীতে পরিণত হচ্ছে।

জোচ্চোরি, চুরি এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অতিধনী পুঁজিবাদী একটি গোষ্ঠীর ভাগ্য খুলে গিয়েছে। জনগণের জন্য বরাদ্দ টাকা মেরে দিয়ে তারা নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করে চলেছে, অন্যদিকে জনগণকে পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি এবং বইতে হচ্ছে ঋণের বোঝা। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই, লেবাননের সরকার মার্চ মাসে ঋণ পরিশোধের অপারগতা স্বীকার করে নিজেদের। আক্ষরিক অর্থেই দেশটি এখন দেউলিয়া অবস্থায় পতিত হয়েছে।

সরকার এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন লোন প্যাকেজের আশায় পথ চেয়ে আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া মহলও লেবাননের বুর্জোয়াদের ভাবমূর্তি মন্দ হবার কারনে এবং দুর্নীতিতে শীর্ষে থাকার কারনে বৈরুতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী নয়।

তার মানে এই না যে আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া শ্রেণী দুর্নীতির নৈতিক প্রশ্ন নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন, বরং তারা এটা নিয়ে শংকিত যে উক্ত বিনিয়োগ বা ঋণ মূলত বৈরুতের দুর্নীতিবাজ বুর্জোয়ারা আত্মসাৎ করে ফেলে নতুন ঋণের বোঝা তৈরী করবে, যেটা পরিশোধ করতেও তারা অপারগ।

স্বাভাবিকভাবেই এসবই মূলত তাদের গরিমসির কুফল। তবে এখন যাইহোক, হয়তো এই ভয়ঙ্কর মানব ট্রাজেডির কারনে তারা কিছুটা হলেও আত্মসাৎকৃত নিজের গাটের পয়সা খরচ করতে বাধ্য হবে। তবে সেটি কোনও মানবকল্যাণের চিন্তার জায়গা থেকে নয়, বরং উক্ত অঞ্চলে লেবানন সরকারের দখল হাতছাড়া হবার ভয়ে।

তবে তথাকথি এসব আন্তর্জাতিক সাহায্যও মূলত লেবাননের সংকট সমাধানে কোনও সাহায্য করতে পারবেনা। এটি সমাধানের বদলে বরং ঋণের বোঝাই বাড়াবে। লেবাননের জনগণ যেসব সমস্যার কথা বিলের মাধ্যমে প্রকাশিত করেছে তার একটি সমস্যাও এভাবে সমাধান হবেনা।

কোভিন-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাব খুব জোরেসোরেই আঘাত করেছে লেবাননে অন্যান্য দেশের তুলনায়, মরার উপর খাড়ার ঘা রূপে এটি দানা বেঁছেছিল। শ্রমিকদের হাতে না খেয়ে মরা অথবা জীবন বাজি রেখে খাবার যোগাতে নেমে ভাইরাসের আক্রমনে মারা যাওয়া, এই দুইটি অপশন বাদে আর কোনও উপায় নেই।

সবাইকে হটাও!

যতক্ষন পর্যন্ত লেবাননের মানুষের জীবন মুষ্টিমেয় লোভী কোটিপতি এবং তাদের দুর্নীতিবাজ পাপেট রাজনীতিবিদদের হাতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মূলত কিছুই পরিবর্তন হবেনা।

হেজবোল্লাহ নামক দল যারা নিজেদেরকে গরীব মানুষের বন্ধু বলে দাবী করে, তারা ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় থেকে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে সরকার গঠনের ডাক দিয়েছিলো। কিন্তু তারাইবা গরীব এবং শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের জন্য কী করেছে আদতে? এরা কিছু কঠোর পলিসি গ্রহন করেছে যা দিনশেষে বরং তাদের সমর্থনকারী গরীবদেরই বিপক্ষে যায়।

হাসান দিয়াবের নেতৃত্বাধীন লেবাননের নতুন সরকার পুরোপুরিভাবেই উক্ত অঞ্চলের সমস্যাসমূহ সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এটা তেমন আশ্চর্যের কিছুও নয়, কারন তারা সমস্যা সমাধানে সফল হবার কথাও নয়। সরকারের পেছনে মদদ দাতাদের মধ্যে রয়েছে হেজবোল্লাহ, আমাল আন্দোলন, এবং ফ্রি প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্ট। 

এর পূর্বের সরকারের সাথেও এই একই দলগুলো এবং একই রাজনীতিবিদেরাই যুক্ত ছিলেন, যারা দুইবছরের জন্য দেশ চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। এই সরকার কোনওকিছু পরিবর্তন করার সরকার নয়, বরং এরা লেবাননের শাসকগোষ্ঠীর গদি সামলানো এবং স্টাটাস ক্যু বজায় রাখার সরকার, যার ফলে আজ লেবাননের এই পরিণতি।

ক্ষমতাসীন কোনও রাজনীতিবিদদেরকেই আর বিশ্বাস করার কোনও কারন নেই। এদের সবাইকেই হটিয়ে দিতে হবে। জনগণ শুধুমাত্র তাদের নিজের ক্ষমতাকেই বিশ্বাস করতে পারে।

দরকার ভিত্তিগত পরিবর্তন

গত বছর, দেশটির শাসকগোষ্ঠীর গদি কেপে উঠেছিলো গণআন্দোলনের মুখে, এই আন্দোলনের ফলে সকল শ্রেণীপেশার শোষিত মানুষ তাদের গোষ্ঠিভিত্তিক এবং ধর্মভিত্তিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক হয়েছিল সরকারের বিরুদ্ধে।

ষাট লাখ জনসংখ্যার এই ছোট দেশটিতে প্রায় বিশ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলো সরকার পতনের দাবী নিয়ে। এটি পুরো মধ্যপ্রাচ্যের সকল শ্রমিক শ্রেণী এবং যুবকদের জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল- শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, আমি বলবো পুরো বিশ্বের শ্রমিক ও যুবকদের জন্যই।

এমনকি করোনভাইরাস মহামারীর প্রাদুভার্বও এই বিপ্লবী শক্তিকে দমিয়ে দিতে পারেনি। গত ২৮শে এপ্রিল শ্রমিক শ্রেণী আরও একবার রাস্তায় নেমে এসেছিলো সরকারের বিরুদ্ধে।

 লেবাননের শ্রমিক ও যুবক ভাইয়েরা!

এই দুর্বিষহ পরিস্থিতির সমাপ্তি টানার সময় চলে এসেছে।

যেনতেন সংস্কারবাদী সিদ্ধান্তে আর কোনওকিছুই পরিবর্তন হবেনা, পরিবর্তন দরকার ভিত্তিগত জায়গায়- অর্থাৎ বিপ্লব।

আপনাদের হাতে রয়েছে অসীম ক্ষমতা। শ্রমিক শ্রেণীর মর্জি ছাড়া একটি বাতিও জ্বলবেনা, একটি চাকাও ঘুরবেনা, একটি টেলিফোনও বেজে উঠবেনা।

বর্তমানের দুরাবস্থা দূর করতে গেলে, এই অসীম শক্তিকে সমবেত করে নির্মম, দুর্নীতিগ্রস্থ এবং অন্যায়ভাবে টিকে থাকা এই শাসনামলের অবসান ঘটাতে হবে পুরো দেশজুড়ে।

যারা আপনাদেরকে রাজপথ থেকে অব্যাহতি দিতে বলবে, উত্তম সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে বলবে, এসব মনভোলানো কথায় বিশ্বাস করার কোনওই কারন নেই, কারন এদের কারনেই আজ লেবানন এবং আপনাদের এই পরিণতি, সুতরাং এখন এমনটি ভাবারও অবকাশ নেই যে তারাই কোনও অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে আপনাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিবে।

তাদের এই আশ্বাস ঢাহা মিছা কথা, স্থুল ভয়ংকর এবং জঘন্য মিছা কথা- এতকাল ধরে যেসব মিথ্যা আশ্বাস আপনারা শুনে এসেছেন তেমনই মিথ্যা এসব আশ্বাসও।

চলমান সরকার, এই সরকারকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন দেয়া কোনও দল, নেতা কাউকেই বিশ্বাস করার অবকাশ নেই কোনও।

বিশেষ করে তারা আরও বেশি ক্ষতিকর যারা প্রতিবিপ্লবী প্রতিক্রিয়াশীল এবং আপনাদের ক্ষমতাকে বিভিন্ন গোষ্ঠিভিত্তিক অথবা ধর্মভিত্তিক লাইনে আলাদা করে ফেলতে চায়। শ্রমজীবী মানুষের একমাত্র শক্তি তাদের একতায়। আমাদের এই একতার শক্তিকে ভেঙে দিতে চায় যারা বা যা কিছু, সেসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

খ্রিস্টান এবং মুসলমান, সুন্নি এবং শিয়া, নারী এবং পুরুষ, যুবক এবং বৃদ্ধ- সমাজের সকল শোষিত এবং নিপীড়িত মানুষের একতাবদ্ধ হওয়া উচিত জনসাধারনের শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে। একতাই বল, বিভাজনে দুর্বল! এই স্লোগানকে সামনে রেখেই লেবাননের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যেতে হবে!

জনগণ শুধুমাত্র তাদের নিজেদের ক্ষমতাকেই বিশ্বাস করতে পারে, আর কাউকে নয়। একবার যখন জনসাধারণ সমাজ পরিবর্তনের জন্য সংগঠিত হয়ে সামনে আগানো শুরু করে, তখন পৃথিবীর কোনও শক্তিই তাদেরকে দাবায়ে রাখতে পারেনা!

বিস্ফোরণের ভিডিওচিত্রধ্বংসাবশেষের ভিডিও